"স্বপ্ন"-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির নাসির ভাইয়ের সাথে আমি যখন বসেছি, তার আগে থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল এই মিটিং থেকে যেন আমি নতুন কিছু শিখতে পারি।
আমি নিজে যেহেতু এখন উদ্যোক্তা, তাই আমার প্রথম আগ্রহ ছিল ১৬০ টাকার এই গরুর মাংস-আলুর প্যাকেজটি নিয়ে। এটি তিনি কেন চালু করেছেন, এর পিছনে কি ধরণের পরিকল্পনা গিয়েছে, এবং এর ব্যবসায়িক সফলতা নিয়ে।
দ্বিতীয়, এই প্রোডাক্ট চালু হওয়ার পর স্বপ্নের আউটলেটগুলোতে অনেক ভিড় বেড়ে যায়। তখন বাজারে একটা কথা এসেছিল যে স্বপ্নের লয়াল কাস্টমার সেগমেন্ট থেকে অভিযোগ আসছে। কারণ কাউন্টারে লম্বা লাইনের কারণে তাদের সার্ভিস পেতে দেরি হচ্ছে।
জানার আগ্রহ ছিল এই অভিযোগটির সত্যতা কতটুকু এবং হয়ে থাকলে স্বপ্ন কিভাবে সেটা সামাল দিচ্ছে।
তৃতীয় আগ্রহ ছিল এই প্রোডাক্টটির লং টার্ম সাস্টেনেবিলিটি এবং স্কেল-আপ নিয়ে। পাইলট হিসাবে এই প্রোডাক্টটি খুব ভালো করেছে। কিন্তু নিয়মিত একটা প্রোডাক্ট হিসাবে কিভাবে স্বপ্নের ৪০০-৫০০ আউটলেটে এটা স্কেল করার পরিকল্পনা করছেন।
উদ্যোক্তা হিসাবে আমি জানি, ছোট স্কেলে পাইলট করার সময় কোন একটা প্রোডাক্ট বা সার্ভিস সফল হলেও, স্কেল অনেক বড় হলে সেটা আর কাজ করে না। কিংবা স্কেল করার চ্যালেঞ্জগুলো একটা প্রতিষ্ঠান নিতে পারে না।
সাব্বির ভাইয়ের সাথে প্রায় ১ ঘন্টার আলোচনায় এই সবগুলো দিক উঠে এসেছে। আমি অবাক হয়েছি এটা জেনে যে ১৬০ টাকা গরুর মাংসের প্যাকেজটি কেবল একটা মার্কেটিং ক্যাম্পেইন নয়। অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল এটা করে স্বপ্ন কিছু নতুন কাস্টমারকে তাদের আউটলেটে নিয়ে আসতে চেয়েছে। প্রতি মাসেই তো এরকম বিভিন্ন অফার ক্যম্পেইন চলে।
কিন্তু একইসাথে অবাক এবং আনন্দিত হয়ে জানলাম, স্বপ্ন তার কাস্টমারদের সাথে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে, কাস্টমারদের একটা সমস্যা সমাধান করতে, খুবই সচেতনভাবে ডিজাইন করেছে এই নতুন প্রোডাক্ট ক্যাটাগরি।
এই লেখায় আমি তুলে ধরছি স্বপ্নের ভাইরাল ১৬০ টাকার মাংসের প্যাকেজের গল্প এবং এটা থেকে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে ৫টি প্রধান লার্নিং নিতে পারি।
চলুন শুরু করি।
লার্নিং ১ – কাস্টমারের সমস্যা সমাধান করা
স্বপ্নের এই অফারটি কেন চালু করলো? – এই প্রশ্নটির এতো সুন্দর উত্তর আমি আশা করিনি।
সাব্বির ভাইয়ের উত্তরের সারসংক্ষেপ হচ্ছেঃ
একটা রিপোর্টে তিনি জেনেছেন বাংলাদেশের ২২-২৫% মানুষ এখন ফুড ইনসিকিউরিটিতে আছে। লোয়ার ইনকাম গ্রুপে এটা ৩০% এবং মিড ইনকাম গ্রুপে ৮% মানুষ টাকার কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার কিনতে পারছে না।
খরচ বাঁচানোর জন্য তারা প্রোটিন খাওয়া কমাচ্ছে। মানে গরুর মাংস, মুরগির মাংস, মাছ এগুলো খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি সবজি খাওয়া, ফল খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে। তার মানে, যে পরিবারে শিশু আছে তাদের ক্ষেত্রেও এটা ঘটছে। শিশুদের নিউট্রিশন কমে যাচ্ছে। এতে করে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সরাসরি প্রভাব পড়ছে।
দেশের ৪০% শিশু যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে, তারা আগে থেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সাথে যুক্ত হয়েছে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার ক্রাইসিস। তার মানে, এই সংখ্যাটা এখন আরও বেড়ে যাচ্ছে।
সাব্বির ভাইয়ের কথা হচ্ছে, আমরা যদি আমাদের সন্তানদের জন্য ন্যুনতম এতোটুকু নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমরা একটা সুস্থ জাতি কিভাবে আশা করতে পারি।
তাই কিভাবে প্রোটিন খাওয়া বাড়ানোর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে শিশুদের, পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পারি – এই ভাবনা থেকে স্বপ্ন এই মাংসের প্যাকেজটি ডিজাইন করার চিন্তা করেছে।
উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে লার্নিংঃ
কাস্টমারের সমস্যা গভীরভাবে বুঝার চেষ্টা করুন। তার সাথে সময় কাটান। তাকে প্রশ্ন করুনঃ আপনার কি কি পেইন পয়েন্ট? এবং সেটার ন্যুনতম সমাধান কি হতে পারে?
কাস্টমারই আপনাকে সব বলে দিবে। সেটা অনুযায়ী প্রোডাক্ট বা সার্ভিস ডিজাইন করুন। তাতে করে আপনার সমাধান কাস্টমাররাই জনপ্রিয় করবে।
লার্নিং ২ – প্রোডাক্ট ডিজাইন
স্বপ্ন প্রথমে বেশ কিছু মধ্যবিত্ত ৩-৪ সদস্যদের ছোট পরিবারদের সাথে কথা বলল। তারা জানালো যে, একসময় গরুর মাংস তারা কিনতো, এখন আর কিনে না। যখন জিজ্ঞেস করা হল যে ন্যুনতম একবেলা মাংসের তরকারি খেতে কি লাগবে?
আলোচনায় উঠে এলো যে ৮-১০ টুকরা মাংস আর সমান সংখ্যক আলুর টুকরা হলেই একবেলা হয়ে যাবে। তাদের সাথে বসেই দাম ঠিক করা হল – ১৬০টাকায় তারা কিনবে।
এরপর স্বপ্নের টিম সেই একই সংখ্যক মাংস আর আলুর টুকরা দিয়ে মাংসের তরকারি রান্না করে আবার কাস্টমারদের কাছে গেলো। তারা জানালো যে তারা পছন্দ করেছে। এবং এরকম হলে তারা কিনবে।
উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে লার্নিংঃ
কাস্টমারের কোন সমস্যা সমাধান করতে কাস্টমারের সাথেই আলোচনা করে প্রোডাক্ট ডিজাইন করা উচিত। নতুন ডিজাইন করা প্রোডাক্ট বা সার্ভিসটি আবার কাস্টমারের কাছে নিয়ে যান। তার কাছ থেকে ফিডব্যাক নিন। যদি সে কোন কিছু পরিবর্তন করতে বলে সেটা করুন।
লার্নিং ৩ – প্রোডাক্ট প্রাইসিং
এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইন্টারভিউ কিংবা ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করুন কাস্টমারের সাথে। স্বপ্ন কাস্টমারের সাথেই আলোচনা করে প্যাকেজের দাম নির্ধারণ করেছিলো – ১৬০টাকা। স্বপ্ন টেস্ট করেছিলো খুব অল্প কিছু নিজস্ব আউটটেলে। প্রথম ৫ দিনেই একটা প্যাকেজ বিক্রি হয়েছে ৭৫ হাজার পিস। খুলনায় স্বপ্নের আউটলেটে ১৪০ টাকায় অফার দেয়া হয়েছে।
আর এতে করে সেম স্টোর রেভিনিউ গ্রোথ হয় ২০%। সারা পৃথিবীতে রিটেইল চেইনগুলো কখনও খুব ভালো করলে ৫-৭% গ্রোথ হয়।
মাংসের প্যাকেজ সফল হওয়ার পরপরই আরও কিছু প্যাকেজ চালু করা হয়। দেখা গেলো একজন কনজিউমার নিয়মিত মাছের প্যাকেজ, মাংসের প্যাকেজ, সবজির প্যাকেজ, কিংবা খিচুড়ির প্যাকেজ – এসব নিচ্ছে।
তাকে জিজ্ঞেস করা হলে জানায় যে, এটা তো আমার জন্য খুব ভালো হয়েছে। সকালে খাবো মাংস, রাতে মাছ, পরদিন খিচুড়ি। ফ্রেশ খেতে পাচ্ছি। খাবারও নষ্ট হচ্ছে না।
উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে লার্নিংঃ
যদি নতুন বা ইউনিক কোন প্রোডাক্ট হয়ে থাকে, যেটা কাস্টমারের কোন সমস্যা সমাধান করে, তাহলে এটার দামটাও কাস্টমারের সাথে আলোচনা করে নিন। নাহলে প্রোডাক্টের চাহিদা থাকলেও, দাম বেশি হওয়ার কারণে সেটা কাস্টমার নিবে না। তখন দোষারোপ হবে মার্কেটিং টিমের।
স্বপ্নের সাফল্য প্রমাণ করে যে, মানুষের চাহিদার প্রতি সঠিক দায়িত্ববোধ থাকলে একটি ব্র্যান্ড ব্যবসায়িক দিক থেকে সফল হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনেও সমর্থ হতে পারে।
লার্নিং ৪ – সমাধানের স্কেল আপ
সাব্বির ভাই আমার মতই ইঞ্জিনিয়ার। আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে, সমস্যা সমাধান করার দক্ষতা। কারণ ইফিসিয়েন্সি দিয়ে ইকোনমি অফ স্কেল আনা সম্ভব। এবং তখন কাস্টমারকে কোন একটা প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কম মুল্যে অফার করা যায়।
সাব্বির ভাই এখন পাইলট করছেন ছোট্ট চিলার দিয়ে সেখানে মাংসের প্যাকেজগুলোকে রাখার ব্যবস্থা করবেন। ইতিমধ্যে প্রাথমিক টেস্টে দেখা গেছে মাংস ও আলু কয়েকদিন পর্জন্ত টাটকা থাকে। তাই এখন ছোট ভার্টিকাল চিলার ডিজাইন হচ্ছে। ৩-৬ মাস সময় লাগবে। মাংস ও মাছ দুইটাই ভালো আছে।
তার মানে এখন স্বপ্নকে আর স্টোরে এগুলো কাটতে হবে না। সরাসরি প্যাকেজ করে স্টোরগুলোতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এতে করে দ্রুত সার্ভিস দেয়া যাবে। কাস্টমারদের লম্বা লাইন নিয়ে কমপ্লেইনও থাকবে না। আর খুব ভিড় হলে আলাদা একটা লাইন করে দেয়া হবে কাউন্টারের সামনে, যারা স্বপ্নের মেম্বার তারা তাড়াতাড়ি বিল পরিশোধ করতে পারবে।
বর্তমানে স্বপ্নের ৪৪০টা ফ্রেঞ্চাইজ আউটলেট সারা বাংলাদেশে। সেগুলোর সাইজও খুব ছোট। তাই উপজেলা পর্যায়ে স্বপ্নের এই আউটলেটগুলোতেই তিনি ছোট চিলার দিয়ে পাইলট করবেন। সেখানে সফল হলে এই উদ্যোগ সারা দেশের সব আউটলেটে স্কেল করা হবে।
উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে লার্নিংঃ
স্কেল আপের সমস্যার সমাধান অনেক সময় প্রোডাক্টের প্রোডাকশনের চেয়ে প্রোডাক্টের স্টোরেজ, কিংবা সাপ্লাই চেইনে নীহিত। তাই যেকোনো সল্যুশনকে স্কেল আপ করতে আশেপাশের সবকিছুকেই বিবেচনা করতে হবে। নাহলে স্কেল আপ ফেইল করবে।
লার্নিং ৫ – সঠিক বিজনেস মডেলে মানুষের উপকার করেও লাভ করা যায়
একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে মানুষের উপকারে আসবে এমন উদ্যোগ ব্যবসায়িকভাবে সফল হয় না। এবং এই ধরণের উদ্যোগ শুধুমাত্র নন-প্রফিট হওয়া উচিত। তবে, “স্বপ্ন” এর এই প্যাকেজ প্রমাণ করেছে যে, একটি দায়িত্বশীল উদ্যোগও ব্যবসায়িক সফলতা আনতে পারে। এই প্যাকেজটি বাজারে আনার পর থেকে "স্বপ্ন" এর স্টোর রেভিনিউ ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ২০% কাস্টমার বেশি এসেছে এই অফারের কারণে। কিন্তু পরে সাব্বির ভাই ক্লিয়ার করলেন যে ২০% রেভিনিউ বেড়েছে। মাত্র ১৬০টাকার একটা প্যাকেজ (যেটা থেকে প্রায় কোন লাভই নেই), সেটা কিভাবে এতো রিভিনিউ বাড়ালো?
যারা ১৬০টাকার মাংসের প্যাকেজ কিনতে এসেছে, তারা চাল কিনেছে, মসলা কিনেছে, সবজি কিনেছে। এভাবে করেই একজন মানুষ স্বপ্নে এসে ১৬০টাকার মাংসের প্যাকেজ কিনতে এসে হয়তো আরও ৫০০টাকার জিনিস কিনে বের হয়েছে।
উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে লার্নিংঃ
সামাজিক একটা সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে স্বপ্ন মানুষের হৃদয়ও জয় করলো, পাশাপাশি ব্যবসায়িকভাবেও সফলতা আনলো।
সাব্বির ভাইয়ের মতে, একটি সফল ব্র্যান্ড তখনই তৈরি হয় যখন সেটি কেবল লাভের জন্য নয়, বরং সমাজের প্রকৃত সমস্যাগুলোর সমাধানে নিবেদিত থাকে। তাই স্বপ্নের লক্ষ্য শুধু পণ্য বিক্রি নয়; বরং মানুষকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য এবং বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। "স্বপ্ন" এই দায়িত্বটা পালন করছে।
১ ঘন্টার এই আলোচনায় আরও গভীর কাস্টমার ইনসাইট, সাব্বির ভাইয়ের নিজের জীবন দর্শন, এবং স্বপ্নের ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে অন্য কোন লেখায় শেয়ার করবো।
উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী কিংবা মার্কেটিয়ারদের জন্য, এই ৫টি প্রধান লার্নিং শেয়ার করলাম। আশা করি, অনেকেই উপকৃত হবেন।